একটি আণবিক কাহিনী


ইলেকট্রন ও প্রোটন দুই বন্ধু। সেদিন রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।

ইলেকট্রনঃ তোরে (প্রোটনকে ইংগিত করে) দেখলে আমার বেজায় হিংসা হয়।

প্রোটনঃ কেন? হঠাৎ তোর আবার কিসের এত হিংসা!  

ইলেকট্রনঃ তুই কেন্দ্রে বসে থাকিস, আর আমাকে দিন-রাত ঘুরতে হয়। শুধু কী তাই, কখন কোন পথে ঘুরতে হবে সেটাও ঠিক নাই। কখনো বৃত্তাকার, কখনো উপবৃত্তাকার, ঘড়ির কাটার দিকে ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে। মাঝে মাঝে আমার মাথা ঘোরে, মাঝে মধ্যে বমি-বমি ভাব হয়। বমি করি না তোর কথা ভেবে, তুই নিচে থাকিস তোর উপরে পড়তে পারে তাই। এভাবে চলতে থাকলে আমি তো একদিন পাগল হয়ে যাব।

(হঠাৎ ট্রেনের বিকট শব্দের হুইসেল। শব্দ শক্তির আঘাতে ইলেকট্রন শক্তি অর্জন করে লাফ দিয়ে উপরে উঠল। )

প্রোটনঃ ও আচ্ছা। আর আমার অবস্থা চিন্তা কর। আমি বসে থাকি, কথা সত্যি। কিন্তু তুই মনে হয় ভুলে গেছিস, তোকে উপরে ধরে রাখাই আমার কাজ। নিচ থেকে তোরে ঠেলে ধরে রাখতে আমার হাত গুলো ব্যাথায় চিন চিন করে। শব্দ থেমে গেছে তুই নিচে নেমে আয়। (ইলেকট্রন লাফ দিয়ে আবার নিচে চলে আসল এবং সেই সাথে কিছু শক্তি ছেড়ে দিল)

ইলেকট্রনঃ তুই কী জানিস! আমি ক্যালকুলেটর ছাড়াই আমি অনেক বড় বড় অথবা অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিসাবও করতে পারি।

প্রোটনঃ যেমন-

ইলেকট্রনঃ এই যেমন কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা বিবেচনা কর। শব্দ শোনার আগে আমার কাছে -13.6eV শক্তি ছিল। আমি শব্দ থেকে +10.2eV শক্তি অর্জন করলাম। ফলে উপরে উঠে আমার মোট শক্তি -3.4eV হল। ট্রেন চলে যাবার পর, আমি আবার +10.2eV শক্তি ছেড়ে দিলাম।

প্রোটনঃ তো, হিসাবটা করলি কোথায়? আর যে সংখ্যা গুলো বললি ঐগুলো ছোট-ছোট সংখ্যা।

ইলেকট্রনঃ আরে গাধা, তুই মনে হয় কোয়ান্টাইজেশন অব এনার্জি আর ব্যান্ড গ্যাপ এনার্জির কথা ভুলে গেছিস। তাই না?  সহজ ভাবে বুঝানোর জন্য eV এককে বলেছি। 1 eV মানে হল 1.6×10^-19 জুল।

প্রোটনঃ কি বলিস। আর ভুলে যাব কেমনে, আমি তো জানি না। বুঝিয়ে বল।

ইলেকট্রনঃ কোয়ান্টাইজেশন মানে শক্তির নির্দিষ্টকরন। আমি যখন যে কক্ষপথে থাকি সেখানে আমার একটি নির্দিষ্ট মানের শক্তি থাকে, কমও না বেশিও না। আবার উপরে লাফ দেওয়ার সময় ভেবে চিনতে লাফ দিতে হয়। এমন শক্তিতে লাফ দিতে হয় যাতে পরের ধাপে পৌছাতে পারি। যদি দেখি যথেষ্ট শক্তি নাই, তাহলে বেহুদা লাফ দেই না।

প্রোটনঃ বুঝলাম। হিসাবের বিষয়টা কোথায়? আর একটু বুঝিয়ে বল।

ইলেকট্রনঃ শোন তাহলে। মনযোগ দিয়ে শুনবি। কিন্তু কার যেন আওয়াজ শুনলাম। তোর পাশে কেউ আছে নাকি?  

প্রোটনঃ হ্যাঁ, আছে। নিউট্রন। ও নাকি এগুলো কিছু বোঝে না। এজন্য প্যাচাল পারছে।

ইলেকট্রনঃ ওরে কানে আংগুল দিয়ে থাকতে বল। হ্যাঁ যা বলছিলাম- আমি যখন ভূমিতে থাকি তখন আমার কাছে  -13.6eV শক্তি থাকে। উপরে যাওয়ার জন্য 10.2eV জুল শক্তি দরকার। ওদিকে ট্রেনের হুইসেলে 15eV জুল শক্তি ছিল। বাস, হুইসেল থেকে 10.2eV জুল শক্তি নিয়ে লাফ দিয়ে উপরের ধাপে উঠলাম। উপরে উঠতে মজাই লাগে।

প্রোটনঃ হুম। বুঝলাম। তো ব্যান্ড গ্যাপ টা কী?

ইলেকট্রনঃ আরে, বুঝলি না! নিচের ধাপ থেকে উপরের ধাপে যাওয়ার জন্য যে শক্তি দরকার, সেটাকেই ব্যান্ড গ্যাপ এনার্জি বলে। বাংলায় বলে নিষিদ্ধ শক্তি ফাক। উপর থেকে নিচে নামার সময়ও সেম কাহিনী। তবে এখানে একটা নতুন ঘটনা আছে।

প্রোটনঃ সেটা আবার কী?

ইলেকট্রনঃ আমি যখন উপর থেকে নিচে নেমে আসলাম, তুই কী কোনো আলো দেখতে পেয়েছিস?

প্রোটনঃ না তো। সূর্যের আলো ছাড়া আমি আর কিছু দেখতে পাই নাই।

ইলেকট্রনঃ দেখবি কেমনে! ওইটাতো অদৃশ্য আলো ছিল।

প্রোটনঃ কী কস। এটা আবার কেমন আলো।

ইলেকট্রনঃ ঠিক বলছি তোরে। কিছু কিছু আলো দেখা যায় না।  আলোকে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বলে। এই তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের উপর আলোর রং নির্ভর করে। যেমন নীল রঙ্গের আলোর দৈর্ঘ্য কম, আবার লালের দৈর্ঘ্য বেশি। আবার অবলোহিত আলোর দৈর্ঘ্য আরও বেশি। এইজন্য এই আলো চোখে দেখা যায় না। কী বুঝলি?

প্রোটনঃ আলোকে চিনলাম। কিন্তু তুই যখন নিচে নামলি তখন আলো বের হল কীভাবে? আর আলোর রংটাই বা কার উপর নির্ভর করে?

ইলেকট্রনঃ ও আচ্ছা। বলছি শোন। কোন রঙ্গের আলো বের হবে সেটা নির্ভর করে আমি কত উপর থেকে ভূমিতে নেমে আসলাম। নিচে নামার সময় যে শক্তি ছাড়ি, ঐ শক্তি যে রঙ্গের আলোর সাথে মিলে যায় সেই রঙ্গের আলোই দেখা যায়। দৃশ্যমান আলোর শক্তির সমান না হলে অদৃশ্য আলো বের হয়। ঐ সময় অতিবেগুনী রশ্মি বের হয়েছিল। তাই দেখা যায় নাই।

প্রোটনঃ ও আচ্ছা এতদিন পরে বুঝলাম। কেন তোকে নিয়া  কিছু পাগল মানুষ যারা রাত নাই দিন নাই ল্যাবে পড়ে থাকে!!! আর তোকে নিয়ে টানা হেচড়া করে এই ঘটনা জানার জন্য। কিন্তু এত কষ্ট করার দরকার কী! তোকে জিজ্ঞাস করলেই তো পারে।  

ইলেকট্রনঃ আরে দোস্ত, তুই আসলে একটা গাধা। জিজ্ঞাস করলেই সবকিছু বলে দিব নাকি। তাহলে আমাদের দাম কমে যাবে না?  

প্রোটনঃ হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। এই সুযোগে তো তোর সাথে আমি বিশ্বের নামি-দামি ল্যাব গুলো ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পাচ্ছি।

(হঠাৎ কান-ফাটা আওয়াজ। স্টেশনে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ। এদিকে ইলেকট্রনকে আর খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। )

প্রোটনঃ দোস্ত কোথায় গেলি তুই। তোকে ছাড়া আমি বাচব কীভাবে?

(ইলেকট্রনকে হারিয়ে প্রোটন দুঃখে কাতর, আর আমরা বলি এই ঘটনায় নাকি পজিটিভ চার্জের সৃষ্টি হয়েছে। কী আজীব মানুষ আমরা!!!)

বিঃদ্রঃ শব্দ শক্তি কে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ডিভাইস তৈরীতে এখন গবেষণা হচ্ছে। উল্লেখ্য, আমার পিএইচডির গবেষণার বিষয় এরকমই একটা বিষয় নিয়ে।

লেখক-

মোঃ দেলোয়ার হোসেন, প্রভাষক, পদার্থবিদ্যা

ওএসডি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *