বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৬০০০ কিমি উপরে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে? ২৬০০০ কিমি হলে কী ঘটবে?

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সহ অন্যান্য ভূস্থির উপগ্রহ পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে প্রায় ৩৬০০০ কিলোমিটার উপরে পৃথিবীর সমান্তরালে ৩.০৭ কিমি/ঘণ্টা গতিতে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। স্যাটেলাইট বা যেকোনো নভোঃযান যত উপরে উঠবে ততই জ্বালানী খরচ বেশি হবে। প্রশ্ন হল ভূস্থির উপগ্রহকে পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে এত এত উপরে কেন স্থাপন করতে হবে? স্যাটেলাইটের উচ্চতা ৩৬০০০ কিমি না হয়ে যদি ২৬০০০ কিমি হত তাহলে কী ঘটত? বুঝতে হলে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক দুটি নীতি আপনাকে জানতে হবে।
নীতি-১: নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মূল কথা হল এই যে বস্তু জগতের কোনো ঘটনায় বল জোড়ায় জোড়ায় ক্রিয়াশীল থাকে। মানে ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয় এই আর কি! মেঝের উপর ৮০ কেজি ভরের কোনো কোনো বস্তু বা মনুষ্যজাত মেঝের উপর যে বল প্রয়োগ করে, মেঝেও ঐ বস্তু বা মনুষ্যজাতের উপর একই প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে। মোটকথা কোনো বস্তু সাম্যাবস্থায় থাকুক বা না থাকুক একই সময়ে তার উপর কমপক্ষে দুটি বল ক্রিয়াশীল থাকে। বল দুটি মানে সমান অথবা ভিন্ন মানের হতে পারে কিন্তু তাদের দিক পরস্পরের বিপরীত। জোড়া বল মানে সমান হলে বস্তুটির সাম্যাবস্থায় থাকবে।
নীতি-২ : কেন্দ্রমুখী বল ছাড়া কোনো বস্তু বৃত্তাকার পথে ঘুরতে পারে না। অর্থাৎ যদি দেখি যে কোনো বস্তু বৃত্তাকার পথে ঘুরছে তাহলে বুঝতে হবে সেখানে কেন্দ্রমুখী বল কাজ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন্দ্রমুখী বল কী? কোনো বস্তু বৃত্তাকার পথে ঘুরবার সময় কেন্দ্রের দিকে টান বা বল অনুভব করে তাকে কেন্দ্রমুখী বল বলে। নীতি-১ কে যদি নীতি-২ এর সাথে সংযোজন করি তাহলে বলতে হবে যে বৃত্তাকার পথে ঘুরবার সময় বস্তু কেন্দ্রের বিপরীত দিকেও একটি সমান বল অনুভব করে তাকে কেন্দ্রবিমুখী বল বলে। অবশ্যই, বৃত্তাকার পথে ঘূর্ণনরত কোনো বস্তুর উপর ক্রিয়াশিল এই দুই বল মানেসমান কিন্তু বিপরীতমুখী।
কেন্দ্রমুখী বল সহজভাবে বুঝানোর জন্য আমি সাধারণত শিক্ষার্থীদের একটি গল্প শুনাই। গল্পটি হল এই-
ধরুণ ইলেকট্রন নামের কোনো শিক্ষার্থী বগুড়া শহরে বসবাস করে। একদিন ইলেকট্রনের মন খারাপ হল। প্রিয়জনের উপর রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছ ইলেকট্রন? বলে যে দুচোখ যেদিকে যায়!!! কিন্তু দিন শেষে দেখা গেল যে ইলেকট্রন বগুড়া শহরের বাউন্ডারি দিয়ে ঘুরছে। শহর সে ত্যাগ করতে পারছে না। কারণটা কী? কারণ হল কেন্দ্রের (পরিবারের) দিকে টান। হয়ত তার প্রিয়জনের (মায়ের) কথা মনে পড়েছে সেকারণে সে আর শহরের সীমানা ত্যাগ করে দুচোখ যে দিকে যায় সেখানে যেতে পারছে না। মায়ার এই টানের নামই কেন্দ্রমুখী বল। কিন্তু কোনো কারণে পরিবারের এই মায়ার টান ছিড়ে গেলে ইলেকট্রন হয়ত হারিয়ে যেত কোনো এক দূর অজানায়।
এই দুটি নীতি অনুযায়ী বলা যায় যে পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে উপরে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনরত কোনো স্যাটেলাইটের উপর দুটি বল ক্রিয়াশীল তাদের একটি কেন্দ্রমুখী অপরটি হল কেন্দ্রবিমুখী। আগেই বলেছি বল দুটি মানে সমান কিন্তু দিক বিপরীত। ইলেকট্রন নামের ঐ শিক্ষার্থী যদিও পরিবারের মায়ার টানে শহরের সীমানা পাড়ি দেয় নাই অজানা পথে। কিন্তু স্যাটেলাইটের উপর কিসের এই টান যার কারণে এই কেন্দ্রমুখী বলের সৃষ্টি হয়? হ্যাঁ, পাঠক আপনি সত্য বলেছেন। স্যাটেলাইটের উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল বা অভিকর্ষ বল। সমীকরণের সাহায্যে এই বলের মান নির্ণয় করা সম্ভব।
যেখানে, G=সার্বজনীন মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, M=পৃথিবীর ভর, m=স্যাটেলাইটের ভর, R=পৃথিবীর ব্যাসার্ধ, এবং h=পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে স্যাটেলাইটের উচ্চতা
অপরদিকে নীতি-১ এবং নীতি-২ অনুযায়ী স্যাটেলাইটের উপর কেন্দ্রবিমুখী বল ক্রিয়াশীল হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল এই বলের উৎস কী? বল তো আপনাআপনি সৃষ্টি হবে না। কেন্দ্রবিমুখী বলের মান নিম্নের সমীকরণ থেকে নির্ণয় করা যায়।
উক্ত সমীকরণ থেকে দেখা যায় যে কেন্দ্রবিমুখী বলের মান স্যাটেলাইটের রৈখিক বেগের উপর নির্ভর করে। রৈখিক বেগ যত বেশি হবে কেন্দ্রবিমুখী বলের তত বেশি হবে।
এবার আসি উচ্চতা প্রসঙ্গে। কোনো বস্তুর উপর আকর্ষণ বল বা ওজন বল বা অভিকর্ষ বল বা মহাকর্ষ বলের মান বস্তুর কেন্দ্র এবং পৃথিবীর কেন্দ্রের মধ্যবর্তী দূরত্বের উপর নির্ভর করে। দূরত্ব যত বেশি হয় বলের মান তত কমতে থাকে। স্যাটেলাইট যত উপরে অবস্থান করবে ততই তার উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বলের মান কম হবে। ফলে অভিকর্ষ বল দ্বারা সৃষ্ট স্যাটেলাইটের উপর ক্রিয়াশীল কেন্দ্রমুখী বলের মান যত কম হবে কেন্দ্রবিমুখী বলের মান ততই কম হবে। আর কেন্দ্রবিমুখী বলের মান যত কম হবে স্যাটেলাইটের রৈখিক বেগ ততই কম হবে। অর্থাৎ স্যাটেলাইটকে পৃথিবীর সমান্তরালে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরাতে কম শক্তির প্রয়োজন হবে। জ্বালানী খরচ করে একবার স্যাটেলাইটকে যতবেশি উচ্চতায় পার্কিং করানো হবে পরবর্তীতে মেইনটিন্যান্স খরচ তত কম হবে। স্যাটেলাইটের রৈখিক বেগ সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত তড়িৎশক্তির পরিমাণও কমে যাবে।
তাহলে শেষ প্রশ্ন আসে ৩৬০০০ কিমি উপরে কেন? ২৬০০০ কিমি হলে কী ঘটবে?
এককথায় এই প্রশ্নের উত্তর হল জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূস্থির উপগ্রহ স্থাপনের জন্য স্যাটেলাইটকে ৩৬০০০ কিমি উপরে নেয়া হয়। ভূস্থির উপগ্রহ হল সেই উপগ্রহ যার আবর্তন কাল পৃথিবীর নিজ অক্ষের উপর আবর্তন কালের সমান অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা। স্যাটেলাইটের আবর্তনকাল অর্থাৎ কক্ষপথে একবার ভ্রমণ করতে যে সময় লাগে তা উচ্চতার উপর নির্ভর করে।
স্যাটেলাইটের উচ্চতার সমীকরণ নিম্নরূপ-
উক্ত সমীকরণে অন্যান্য রাশির মান সহ আবর্তন কাল, T এর মান ২৪ ঘণ্টা বা ২৪*৩৬০০ সেকেন্ড বসালে উচ্চতার মান আসে ৩৫৯০৩ কিমি যা প্রায় ৩৬০০০ কিমি এর সমান। অপরদিকে কোনো স্যাটেলাইট যদি পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে ২৬০০০ কিমি উপরে ৩.০৭ কিমি/ঘণ্টা বেগে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার চেষ্টা করে তাহলে স্যাটেলাইট কিছুদিন পর ভূপৃষ্ঠে আছড়ে পড়বে। কারণ হল দূরত্ব কম হওয়ার কারণে অভিকর্ষ বলের মান কমে যাবে ফলে কেন্দ্রমুখী বলের মানও বেড়ে যাবে। অপরদিকে রৈখিক বেগ একই থাকার জন্য কেন্দ্রবিমুখী বলের মান একই থাকবে কিন্তু তা হবে কেন্দ্রমুখী বলের চেয়ে কম। কেন্দ্রমুখী বলের মান বেশি হওয়ার কারণে স্যাটেলাইট কোনো একদিন পৃথিবী পৃষ্ঠে আছড়ে পড়বে।
এবার বুঝলাম বন্ধু।