স্বপ্ন যখন পিএইচডি
স্বপ্ন যখন পিএইচডি
পর্ব-১
আমি কুড়িগ্রামের ছেলে। ব্রহ্মপূত্র নদের অববাহিকায় আমার বাড়ি। বাড়ি থেকে বড়সড় একটি লাফ দিলে নিশ্চিত নদীতে পড়ে যাব। এমন গ্রামে আমার জন্ম, যে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আজও দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। বাবা কৃষক কিন্তু স্বপ্ন তার পাহাড় সমান। ছেলে বড় হবে, শিক্ষিত হবে। যখন পাড়ার অন্য ছেলেরা জমিতে লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করত, আমি তখন পড়ার টেবিলে কলম দিয়ে খাতায় জ্ঞান চাষ করতাম। (দুটোই ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব বহন করে; কোনো পেশাকে হেয় করা আমার উদ্দেশ্য নয়)। বাবা নিজে জমিতে চাষাবাদ করে নিজের সাদা চামড়াকে পুড়িয়ে কালো বানিয়েছেন, তবুও আমাদের লেখাপড়া নষ্ট হবে এমন কোনো কাজ করতে দেন নাই। স্যালুট বাবা। বাবা বেঁচে আচেন। বাবা দীর্ঘজীবী হোন। অন্য দশ সেরা বাবার মধ্যে আমার বাবা একজন।
মায়ের কথা কী বলব! ছোটবেলায় প্রায়ই স্কুলে যাবার আগে নদীতে গোসল করতাম। দু-চার মিনিট নয়, ঘন্টা খানেক পানিতে ডুবাডুবি। পানিতেই খেলা। আহ! কী সুখস্মৃতি।এখনো মনে হলে সমস্ত দুখ ভুলে যাই আমি। একদিন নদীতে গোসল করে বাসায় ফিরতে দেরি হল। আমি মাকে বললাম, মা আজ স্কুলে যাব না। মা বললেন, স্কুলে যা বাবা, স্কুল কামাই (মিস) দিস না। আমি নাছোরবান্দা স্কুলে যাব না। মা ও জিদ ধরেছে, আমাকে স্কুলে পাঠাবে। মা গাছের ডাল ভেঙে হাতে নিলেন, আমার দিকে আসলেন। আমি অপেক্ষা করছি, দেখি মা কী করে! মা গাছের ডাল দিয়ে পিঠে মারলেন। আমি কাঁদতে থাকলাম। মা কাঁদলেন না। হাতে বই তুলে দিয়ে বললেন, স্কুলে যা, না হলে বাড়িতে উঠতে দেব না। আমি কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে গিয়েছিলাম। মায়ের সেই শাসন, আজ আমার জন্য আশীর্বাদ। মায়ের দোয়া, আজ আমার সমস্তকিছু। মা-বাবা স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন দেখিয়েছিন, কীভাবে বড় হতে হয়। আমিও স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। স্বপ্ন আমার পূরণ হতে চলেছে। আমি আজ পৃথিবীর অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যানুধিক ক্লিন রুমে সোলার সেল (সৌর শক্তি উৎপাদনের ডিভাইস বা সোলার প্যানেল) নিয়ে গবেষণা করছি। আমি ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ সারে তে পিএইচডিতে অধ্যয়ন করছি।আলহামদুলিল্লাহ।।।
এবার আসা যাক মূল গল্পে। ২০১৩ সাল। গল্প শুরু হয় মাস্টার্স পরীক্ষা চলাকালীন। বন্ধু সাকিবের পরামর্শে শুরু করি IELTS প্রস্তুতি। স্বপ্ন দেখি অস্ট্রোলিয়াতে পিএইচডি করতে যাব। প্রস্তুতি যাই হোক, ফলাফল হল ৬.৫। কিন্তু writing সেকশনে ৫.৫ থাকায় ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারলাম না। সাকিব ঢাকার একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জবে জয়েন করল। আমি বিসিএস দিয়ে পাটগ্রাম সরকারি কলেজ (প্রকৃত নামঃ সরকারি জসমুদ্দিন কাজী আব্দুল গণি কলেজ ,পাটগ্রাম) এ প্রভাষক, পদে জয়েন করলাম। সাকিবের সাথে যোগাযোগ হল না অনেকদিন। স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হল জীবনের নতুন অধ্যায়।
২০১৪ সাল (পাটগ্রাম পর্ব)। সংসার জীবন এবং কর্মজীবন একসাথে শুরু হল। সংসার জীবন আর কর্মজীবনের সেকি টানাটানি খেলা। এই খেলায় অংশগ্রহণ না করলে এর মাহাত্ব বোধগম্য হয় না। টানাটানির খেলায় কখনো হেরেছি, আবার কখনো জিতেছি। হাসি-কান্নাও ছিল পাশাপাশি। যা বলছিলাম- লালমনিরহাট জেলা সদর হতে প্রায় ৮২ কিলোমিটার উত্তরে পাটগ্রাম উপজেলা। ভারতের সাথে সীমান্ত-যোগোযোগ পূর্ণ উপজেলা। বুড়িমারি স্থলবন্দর সহ দেশের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান তিনবঘা করিডোর এই উপজেলায় অবস্থিত। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সরকারি জসমুদ্দিন কাজী আব্দুল গণি কলেজ (পাটগ্রাম সরকারি কলেজ)। পাটগ্রামে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকের সেইরকম দাম। জয়েন করেই বুঝতে পারলাম কয়েকশো শিক্ষার্থী আমার জন্য অপেক্ষা করছে পাটগ্রামে। শুরু হল সকাল সন্ধ্যা পড়ানো। কলেজের ক্লাস টাইম ছিল সকাল ৯.৩০ থেকে বিকেল ৩.০০ টা। কলেজের ক্লাস (ইন্টারমিডিয়েট, ডিগ্রি ক্লাস) এবং পাঁচ থেকে ছয়টা প্রাইভেট ব্যাচ। সবমিলিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কলেজেই থাকতে হচ্ছিল। সেই সাথে যুক্ত হত কলেজের বিভিন্ন কমিটির কাজ। সেইরকম ব্যাস্ত জীবন। কলেজের পরীক্ষা কমিটির কাজের সুবিধার্থে একটা কক্ষ বরাদ্দ ছিল কমিটির সদস্যদের জন্য। নাম ছিল কন্ট্রোল রুম। এই রুমেই কাজের ফাঁকে-ফাঁকে খোশ গল্প চলত। হাসি-ঠাট্টা চলত অনেক রাত ধরে। কন্ট্রোল রুম যে ভবনে ছিল তার উপরেই ছিল শিক্ষকদের জন্য কথিত ডরমেটরি। দূর-দূরান্ত থেকে আগত শিক্ষকদের মাথাগোজার ঠাই হত ঐ ডরমেটরিতে।
একদিনের ঘটনা। আমি কন্ট্রোল রুমে বসে HSC প্রস্তুতি কোচিং এর লেকচার নোট তৈরী করলছিলাম। আয়তাল হক মন্ডল স্যার (সহকারী অধ্যাপক, গণিত) ডরমেটরিতে যাওয়ার সময় রুমে উকি দিলেন। দেখলেন আমি কাজ করছি। কুশল বিনিময় শেষে স্যার চলে গেলেন। পরেরদিন সকাল বেলা আনুমানিক সকাল ৭.০০ টা বাজে তখন, স্যার ডরমেটরি থেকে নেমে নাস্তা করতে হোটেলে যাচ্ছিলেন। দেখলেন কন্ট্রোল রুমের দরজা খোলা। আবারও উকি দেখলেন, আমি একই পোশাকে একই চেয়ারে বসে কাজ করছিলাম। স্যার জিজ্ঞাস করলেন, দেলোয়ার! আপনি কি এখানে সারারাত ছিলেন!!! চোখেমুখে স্যারের বিস্ময়। আমি হেসে উত্তর দিলাম, না স্যার, সকালে আবার এসেছি। ব্যস্ততার এর চেয়ে ভাল উদাহরণ আর কী হতে পারে! কর্মজীবন উপভোগ করতে শুরু করলাম। তবে একটা বিষয় উল্লেখ আমাকে করতেই হবে, কলেজের অভ্যন্তরীণ ক্লাসে ফাঁকি দেয়া আমার অভ্যাস ছিল না। আমি সবসময় চেষ্টা করতাম কলেজের-ক্লাসে প্রাইভেটের চেয়েও ভাল করে পড়াতে, নতুন কিছু দেওয়ার জন্য। প্রজেক্টর দিয়ে পাওয়ারপয়েন্ট-এনিমেশন দিয়ে বিভিন্ন কন্টেন্টের সাহায্যে ক্লাস নিতাম। ফলাফল কী ছিল তার? বুঝতেই পারছেন প্রাইভেটে শিক্ষার্থী বাড়ত। তবে এটাও সত্য যে, ক্লাসে যে চ্যাপ্টার গুলো পড়াতাম, শিক্ষার্থীরা প্রাইভেটে সেই চ্যাপ্টারগুলো পড়তে চাইতো না। ওরা বলত, এই এই চ্যাপ্টারগুলো আমাদের ক্লাসে পড়া হয়েছে, স্যার, এই এই চ্যাপ্টারগুলো প্রাইভেটে পড়ান। আমিও তাই করতাম।
উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পাটগ্রামের মাটিতে ধুলিস্যাৎ হচ্ছিল। হতে দিল না কতিপয় পরোপকারী কতিপয় সহকর্মী। হাবিব স্যার (সিনিয়র সহকর্মী) আমাকে পরামর্শ দিলেন নতুন করে বিসিএস না দিতে। বিসিএস শিক্ষায় থেকে যেতে বললেন। তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতা আমার সাথে শেয়ার করলেন। পরিণামে শিক্ষকতা পেশায় লোভ লেগে গেল। এই লোভ যে আগে থেকে ছিল না তা কিন্তু নয়। লোভ ছিল বিশ্ববিদ্যলায়ের শিক্ষক হওয়ার। আমার অনার্স -মাস্টার্স রেজাল্ট (৩.৬৮, ৩.৯৩২) ভাল ছিল। মেরিট লিস্টেও ছিলাম। কয়েকবার সুব্রত কুমার আদিত্য স্যারের কাছে গিয়েছিলাম, সুপারিশ পাওয়ার জন্য। ভাইভাও দিয়েছেলাম। কপালে বোধ হয় ছিল না। যাইহোক, উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন যখন পাটগ্রামের ধরলা নদী বেয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনি পিছন থেকে টেনে ধরলেন প্রিয় সহকর্মী নাফিস স্যার (সানোয়ার নাফিস বাধন )। এমনভাবে টেনে ধরলেন যে আমাকে ইউকেতে পাঠিয়ে ছাড়লেন। স্বপ্নকে পিছন থেকে আবার কীভাবে টেনে ধরা যায়? হ্যাঁ, আমি সেই গল্পই লিখছি।
নাফিস স্যারের পরামর্শে আবার শুরু হল IELTS প্রস্তুতি। উচ্চশিক্ষার জন্য বিসিএস ক্যাডারদের নাকি কতিপয় স্কলারশিপ আছে জানলাম তৎকালীন পাটগ্রাম কলেজের সুদর্শন, কর্মঠ, জ্ঞানী উপাধ্যক্ষ আলিম আল রাজি স্যারের কাছে। ঘাটাঘাটি (রিসার্চ) শুরু হল। পাশে আছেন সর্বদা নাফিস স্যার। কিন্তু যতই দিন যায় কলেজের কাজের চাপ ততই বাড়তে থাকে। কম্পিউটারের কিছু কাজ জানা থাকায় বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসেবে ডাক পড়ত। আমি না করার ভাষা জানতাম না। ধীরে ধীরে কাজের পরিধি বাড়তেই থাকে। কিন্তু, IELTS এর প্রস্তুতি কী হবে? সরকারি কলেজ গুলোতে বাংলা মাধ্যেমে পড়াতে হয় বলে ধীরে ধীরে সায়েন্টিফিক ইংরেজিগুলোও হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। মরিচা পড়তে থাকে অনার্স-মাস্টার্সে শেখা উচ্চতর পদার্থবিজ্ঞানেও। ইন্টারমিডিয়েট ফিজিক্স নিয়ে ব্যাস্ত থাকতে থাকতে উচ্চতর পদার্থবিজ্ঞান ভুলতে শুরু করলাম।
(চলমান…)
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
আমার এই সফলতার পিছনে শুধুই আমার অক্লান্ত পরিশ্রম নয়। সাধনা রয়েছে আমার বড় ভাইয়ের। বড় ভাই স্বপ্ন পূরনের পথ দেখিয়েছেন। নিজ হাতে সেই পথে তুলে দিয়েছেন, সেই পথে হাটতে অনেকবার হোচট খেয়েছি। হাত ধরে তুলে আবার রাস্তায় রেখে এসেছেন। বড় ভাই আমাকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে এসেছেন। নিজে টিউশনি করে আমার পড়ালেখার খরচসহ অন্যান্য খরচ বহন করেছেন। তিনিও স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন দেখলেন আমাকে নিয়ে, স্বপ্ন পূরনের পথও দেখালেন।
স্বপ্ন পূরণের দীর্ঘ জার্নিতে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন যিনি তিনি আমার জীবনের অর্ধেক। সেই অর্থে আমার অর্জিত পিইচডির (২০২৫ সালে শেষ হবে) অর্ধেক তাকেও দিয়ে দিতে হবে। নিজের চাওয়া-পাওয়া গুলোকে বিসর্জন দিয়ে,আমার স্বপ্ন পূরণের সাথী হলেন। স্কলারশিপের টাকা থাকা সত্ত্বেও আমি যখন লিভিং কস্ট যোগাতে হিমশিম খাচ্ছি, তখন তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাকে যখন আমি ঘরে এনেছিনু তিনি ছিলেন শুধই গৃহবধু। আজ শুধু গৃহবধু নয়, উপার্জন করে অর্থেরও যোগান দিচ্ছেন। কীএক্টা অবস্থা। ভাবতেই অবাক লাগে।
(চলমান…)
all the best bondhu. Hard work always pays off.
অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য। দোয়া করি, সুস্থভাবে ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসেন।
স্যার আমার জীবনে যত ক্লাস করেছিলাম তার মধ্যে অল্প কয়েটা ক্লাস আপনার করেছিলাম। আপনার ক্লাস সবসময়ই সেরা। আজ পর্যন্ত আপনার মত করে কেউ ক্লাস নেয় নি। অনেক মিস করি স্যার আপনাকে। আপনার জন্য দোয়া ও শুভকামনা। আমাদের জন্য একটু দোয়া করেন… ❤️❤️
Alhamdulillah. We should be inspired.